জীবন গাঁথায় এম এন লারমাঃ বাকসাল, আন্ডারগ্রাউন্ড ও এক নেতার দ্বন্দ্ব ( ৭ম পর্ব )

Jumjournal

August 31, 2025

বাকসাল, আন্ডারগ্রাউন্ড ও এক নেতার দ্বন্দ্ব

বাকসালের প্রেক্ষাপট

১৯৭৪–৭৫ সময়টা বাংলাদেশের জন্য ছিল ভয়াবহ অস্থিরতার। দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং বিরোধী দলগুলোকে দমন করার কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে ঘোষণা করলেন বাকসাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ)—একদলীয় শাসনব্যবস্থা।

এই নতুন ব্যবস্থায় সব রাজনৈতিক দলকে ভেঙে বাকসালে যোগ দিতে বাধ্য করা হলো। এম এন লার্মার দল PCJSS–এর উপরও সেই চাপ আসল।

লারমা তখন এক কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি। তিনি জানতেন—

  • যদি বাকসালে যোগ না দেন, তবে তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে চিহ্নিত করা হবে।

  • আর যদি যোগ দেন, তবে তাঁর নিজের মানুষ ভাববে—তিনি আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।

যোগদান কিন্তু দ্বিধা

অবশেষে তিনি কৌশলগত কারণে বাকসালে যোগ দিলেন। ভেবেছিলেন—ভেতর থেকে থাকলে হয়তো পাহাড়িদের দাবির কথা বলা সহজ হবে।

কিন্তু তাঁর ভেতরের দ্বিধা কাটেনি। এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী নাকি পরে বলেছিলেন—
“লারমা তখন বলেছিলেন, আমার হৃদয় মানছে না, কিন্তু বাস্তবতা আমাকে বাধ্য করছে।”

১৯৭৫ এর পরিবর্তন

১৫ আগস্ট ১৯৭৫–এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলেন। রাষ্ট্র আবার অস্থির হয়ে উঠল। সামরিক শাসন জারি হলো। নতুন শাসকেরা পাহাড়ি আন্দোলনের দিকে আরও কঠোরভাবে তাকাল।

লারমা তখন বুঝলেন—এখন আর খোলাখুলি রাজনীতি করা যাবে না। তাঁকে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হবে।

আন্ডারগ্রাউন্ডে যাত্রা

১৯৭৫–এর পর থেকে তিনি বেশিরভাগ সময় গোপনে থাকতেন। কখনো দীঘিনালার ঘন জঙ্গলে, কখনো সীমান্তের কাছাকাছি ছোট ঘাঁটিতে।

গ্রামের মানুষ রাতে গোপনে তাঁকে দেখতে আসত। তাঁরা খাবার দিত, খবর দিত।
কোনো কোনো রাতে তিনি তরুণদের সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন—
“আমরা যদি নীরব থাকি, তবে আমাদের জাতিসত্তা মুছে যাবে। তাই লড়াই চালাতে হবে।”

এই লড়াই তখন শুধু রাজনৈতিক মঞ্চে সীমাবদ্ধ ছিল না, ধীরে ধীরে তা হয়ে উঠছিল সশস্ত্র প্রতিরোধ

সংঘাতের বাড়াবাড়ি

১৯৭৬ থেকে শুরু হলো পাহাড়ে সংঘর্ষ। শান্তিবাহিনীর গেরিলা তৎপরতা বাড়তে লাগল। গ্রামে গ্রামে PCJSS–এর শাখা বিস্তার হলো। একইসাথে সেনাবাহিনীও বাড়াতে শুরু করল নিজেদের উপস্থিতি।

এ সময়ের পাহাড়ে ছিল ভয়ের রাজত্ব—

  • দিনে সেনা টহল

  • রাতে শান্তিবাহিনীর দাপট

  • সাধারণ মানুষ দুই দিক থেকেই আতঙ্কিত

লারমা সবকিছু সমন্বয় করার চেষ্টা করতেন, কিন্তু তিনি নিজেও জানতেন—অবস্থা দ্রুত হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।

কল্পনা করুন—এক পাহাড়ি গ্রামে রাতের বেলা টিমটিমে কুপির আলোয় লারমা বসে আছেন। চারপাশে তরুণরা। তিনি বলছেন—
“আমরা দেশভাগ চাই না, আমরা অধিকার চাই। কিন্তু যদি কেউ আমাদের কথা না শোনে, তবে আমরা কি চুপ করে বসে থাকব?”

সেই রাতের আলোয় জন্ম নিচ্ছে এক আন্দোলন—যা আগামী দুই দশক পাহাড়–সমতলের রাজনীতি নাড়িয়ে দেবে।

©Jumournal-2025

M. N. LARMA

BACK TO TOP