নানিয়ারচরের মহাপুরম গ্রাম—একটি নিভৃত পাহাড়ি জনপদ। চারপাশে সবুজ পাহাড়, মাঝে মাঝে কর্ণফুলীর স্রোত। গ্রামে তখন বিদ্যুৎ নেই, রাস্তাঘাটও কাঁচা। সন্ধ্যা নামলেই কুপি–বাতির আলোয় গ্রামের উঠোন ভরে যেত।
এই গ্রামেই ১৯৩৯ সালে (কিছু সূত্রে ১৯৪১) জন্ম নিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লার্মা। তাঁর পরিবার ছিল সাধারণ চাকমা পরিবার, কিন্তু মা–বাবা দুজনেই ছিলেন শিক্ষাপ্রেমী। বাবা চিত্ত কিশোর চাকমা গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে একজন—সবাই তাঁর কাছে নানা বিষয়ে পরামর্শ চাইত। মা শুভাশিনী দেবী ছিলেন শান্ত, সহৃদয়, কিন্তু সন্তানদের বিষয়ে ছিলেন কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ।
লারমা ছিলেন পরিবারের প্রথম ছেলে। শৈশবে তাঁকে ডাকনামে ডাকা হতো—“লালু”। ছোটবেলা থেকেই তিনি অন্য শিশুদের চেয়ে আলাদা। খেলাধুলা করতেন ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন গল্প শুনতে।
গ্রামের প্রবীণরা যখন সন্ধ্যায় উঠোনে বসে পুরনো দিনের কাহিনি বলতেন—ব্রিটিশ আমলের অভিজ্ঞতা, জুম চাষের গল্প, কিংবা কিভাবে পাহাড়িরা একসাথে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে—লারমা সেসব মন দিয়ে শুনতেন। মাঝে মাঝে তিনি প্রশ্ন করতেন—
“ওরা কেন নিজেদের জমি ছাড়ল?”
“কেন অন্যরা আমাদের মতো থাকতে পারে না?”
এই প্রশ্নগুলো হয়তো ছোটদের সাধারণ কৌতূহল মনে হতো, কিন্তু লার্মার ভেতরে গড়ে উঠছিল সচেতনতার বীজ।
স্কুলে প্রথম পদক্ষেপ
লার্মার গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় খুব ছোট ছিল। বাঁশের বেড়া, টিনের ছাউনি। কিন্তু সেখানেই তিনি প্রথম বই হাতে নিলেন। বাংলা, ইংরেজি, গণিত—সব বিষয়েই আগ্রহী ছিলেন। শিক্ষকরা তাঁকে পছন্দ করতেন কারণ তিনি শুধু মুখস্থ করতেন না, বোঝার চেষ্টা করতেন।
একবার গণিতের ক্লাসে শিক্ষক বলেছিলেন—“এই অংক মুখস্থ করো।”
লারমা তখন বললেন—“স্যার, মুখস্থ করলে কি হবে? কেন এভাবে হয় সেটা যদি না বুঝি?”
শিক্ষক অবাক হয়ে গেলেন। এত ছোট্ট ছাত্রও যে এভাবে প্রশ্ন করতে পারে!
শৈশবের আনন্দ–দুঃখ
ছুটির দিনে লারমা সঙ্গীদের নিয়ে নদীতে সাঁতার কাটতে যেতেন। বাঁশ কেটে ছোট নৌকা বানাতেন, কখনো মাছ ধরতেন। আবার কখনো মায়ের সাথে জুমে কাজ করতে যেতেন—ধান লাগানো, মরিচ চাষ, কচু কাটা—সব কাজেই হাত লাগাতেন।
কিন্তু শৈশব ছিল কেবল আনন্দে ভরা নয়। বর্ষাকালে যখন পাহাড়ি রাস্তা ভেঙে যেত, স্কুলে যেতে কষ্ট হতো। বই ভিজে যেত, অনেক সময় স্কুল ফাঁকি দিতে হতো। আবার মাঝে মাঝে বন্যহাতির ভয়ও ছিল। গ্রামের শিশুদের কাছে এসব ছিল দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা।
লারমা এসব বাধা সত্ত্বেও পড়াশোনায় মনোযোগ হারাননি। তিনি বুঝতে শুরু করেছিলেন—শিক্ষাই হলো সবচেয়ে বড় শক্তি।